গোপালগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের দলের কেন্দ্রীয় নেতা শওকত আলী দিদার হত্যা মামলাকে পুঁজি করে কাশিয়ানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শফিউদ্দিন খান বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তিনি তার পছন্দের উপপরিদর্শক (এসআই) হারুন অর রশিদকে দিয়ে করছেন রমরমা মামলাবাণিজ্য। আসামি ধরা এবং ছাড়ার খেলা করে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। নিরীহ-নিরপরাধ মানুষও তার কাছে জিম্মি হয়ে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে রেহাই পাচ্ছেন। ওসি-এসআইর দাবি পূরণ না হলে নিরীহ মানুষকেও বিভিন্ন মামলায় অজ্ঞাত আসামি করে হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে।
মামলার ভয় দেখিয়ে এক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্যের কাছ থেকে নগদ টাকা ও এসি নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার ওসি শফিউদ্দিন খানের বিরুদ্ধে। এসি কেনাসংক্রান্ত একটি কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে কল রেকর্ডের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ওসি। তাঁর দাবি, কেউ ষড়যন্ত্র করে এসব করেছে।
আড়াই মিনিটের ওই কল রেকর্ড থেকে জানা যায়, কাশিয়ানী থানার ওসি শফিউদ্দিন কাশিয়ানী সদর ইউনিয়নের বরাশুর এলাকার ইউপি সদস্য জাকির হোসেনের কাছ থেকে শার্প অথবা এনার্জি প্যাক ব্র্যান্ডের ২ টনের একটি এসি কিনে দেওয়ার কথা বলেন। গোপালগঞ্জে না পাওয়া গেলে ঢাকা থেকে কিনে এনে দিতে বলেন ওসি।
ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে গোপালগঞ্জ শহরের এলজি-বাটার ফ্লাই কোম্পানির শোরুমের মেমো থেকে জানা যায়, গত ২৩ মার্চ জাকির নিজ নামে ৪০ হাজার টাকা জমা দিয়ে কিস্তির মাধ্যমে এলজি ব্র্যান্ডের একটি এসি কেনেন।
অনুসন্ধানে গিয়ে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর কাশিয়ানী উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যায়। এলাকায় থাকা তৃণমূল আওয়ামী লীগের বিত্তশালী নেতাকর্মীদের টার্গেট করে বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে মহড়া দেওয়া হয়। এরপর থানায় গিয়ে ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়। এজাহারে নাম না থাকলেও শুধু আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক হওয়ায় দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। ওসি টাকা পেলেই মেলে বাড়িতে ঘুমানো ও এলাকায় থাকার নিশ্চয়তা। এভাবেই দেনদরবারে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ওসির গড়ে উঠছে গভীর সখ্য। ওসির আশকারায় অনেক আওয়ামী লীগ নেতা অধরা। অথচ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকা ব্যক্তিরাও হচ্ছেন মামলার অজ্ঞাত আসামি। ঘুষবাণিজ্য থেকে রেহাই পাচ্ছে না দিনমজুরও। এমনকি ওসির কালো থাবা থেকে রক্ষা পায়নি বিএনপি নেতারাও।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, হাসিনা সরকার পতনের পর কাশিয়ানী থানার সকল কর্মকর্তার বদলি হলেও এসআই হারুন অর রশিদের এখনও বদলি হয়নি। ২০২২ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে কাশিয়ানী থানায় যোগদান করেন তিনি। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি ও গ্রেফতারে বেশ ভূমিকা ছিল এসআই হারুনের। দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থাকায় উপজেলার আওয়ামীপন্থি লোকজনের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এসআই হারুন এখনও কাশিয়ানী থানায় বহাল তবিয়তে।
ওসি শফিউদ্দিন শুধু অর্থই ঘুষ নেন না। হাঁস-মুরগি, মাছ-মাংস, দুধ, স্বর্ণ-গহনাসহ বিভিন্ন উপকরণ, এমনকি পায়ের জুতাও উপঢৌকন নেন। উৎকোচ একবার নিয়ে ক্ষ্যান্ত হন না, একই ব্যক্তির নিকট থেকে দফায় দফায় ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তবে অনেকেই নাম প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছে।
এমন ভুক্তভোগী কাশিয়ানী সদর ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য জাকির হোসেন। হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় আসামি করার ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে ২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন ওসি। শুধু তাই নয়, ৫০ হাজার টাকার মাছও ঘুষ নিয়েছেন। গত ২৩ মার্চ ওই ইউপি সদস্যকে আবারও মামলার ভয় দেখিয়ে ওসি শফিউদ্দিন ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকার এসি (শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র) জোরপূর্বক ক্রয় করিয়েছেন। যা তিনি নিজে গোপালগঞ্জ এলজির শোরুমে গিয়ে পছন্দ করে নিয়েছেন এবং থানায় তার ব্যক্তিগত কক্ষে লাগিয়েছেন।
ভুক্তভোগী জাকির হোসেন বলেন, ‘মামলার ভয় দেখিয়ে ওসি আমার কাছ থেকে কয়েক দফা টাকা নিয়েছেন। আবার একটা এসি দাবি করেন। কাছে নগদ টাকা না থাকায় নিরুপায় হয়ে কিস্তিতে কিনে দিয়েছি। ঈদে ছেলে-মেয়েদের নতুন জামাকাপড় পর্যন্ত কিনে দিতে পারিনি। এতেও ক্ষ্যান্ত হননি ওসি, ঈদের আগের দিন আবারও হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে কল করে কিছু টাকা চান তিনি।
সম্প্রতি এসি কিনে দিতে ইউপি সদস্যের সঙ্গে ওসির কথোপকথনের একটি কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়া বাজারের একাধিক ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে ওসি শফিউদ্দিনের গ্রেফতার ও মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে ঘুষবাণিজ্যের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। শতাধিক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ওসি শফিউদ্দিন। কিন্তু মামলার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাশিয়ানী উপজেলার জঙ্গলমুকুন্দপুর গ্রামের বালু ব্যবসায়ী দিহান শেখের সঙ্গে ওসি শফিউদ্দিনের গড়ে উঠেছে গভীর সখ্য। সন্ধ্যার পরেই ভাটিয়াপাড়া ওই যুবকের আস্তানায় চলে ওসি শফিউদ্দিনের আড্ডা। তবে ওখানে ওসির অবাধ যাতায়াত স্থানীয়দের নজরে পড়ায় এখন হোটেল-রেস্তোরাঁয় চলে আড্ডা। ওসির মদতে বেপরোয়া দিহান। এলাকার বালু ব্যবসার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ, চাঁদা আদায়, পুলিশ দিয়ে লোকজনকে ‘ধরা-ছাড়া’ সবই করছেন দিহান। তার দেওয়া তথ্য ও নির্দেশেই কাজ করেন ওসি। দেনদরবার করে দেন দিহান। ওসি বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কথা না শুনলেও দিহানের কথায় সবই করেন।
অভিযোগ রয়েছে, দিহানের নির্দেশেই ভাটিয়াপাড়ার বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য ষাটোর্ধ্ব আব্দুর ছত্তার শেখকে গ্রেফতার করে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে জেলহাজতে পাঠিয়েছেন ওসি। এলাকার অধিপত্য নিয়ে ছত্তার শেখের সাথে দীর্ঘদিন ধরে দিহানের পরিবারের দ্বন্দ্ব চলছিল। পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তার নিরপরাধ ছেলেও। এভাবেই দিহান ওই এলাকায় ‘আতঙ্ক’ হয়ে উঠেছে। শত শত মানুষকে হয়রানি করে আসছেন বলে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। দিহানকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
৯ বছর আগে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত ব্যক্তিকেও আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে মামলায় আসামি করার অভিযোগ উঠেছে। শাহজালাল নামে ওই ভুক্তভোগী পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) কমপ্লেইন সেলে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
অভিযোগে জানা গেছে, ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে কাজ করার অভিযোগে তাকে মাহমুদপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার কোন সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু এসআই হারুন অর রশিদের নেতৃত্বে পুলিশ তার বাড়ি ও এলাকায় গিয়ে একাধিকবার মহড়া দেয়। তাকে বাড়ি না পেয়ে তার পরিবারের লোকজন ও স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার কাছে বলে যান, কিছু টাকা নিয়ে ওসি স্যারের সঙ্গে থানায় গিয়ে যেন দেখা করে আসে।
শাহজালাল নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে আত্মবিশ্বাসী হওয়ায় ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। এতে ওসি-এসআই ক্ষুব্ধ হয়ে গত ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কাশিয়ানী থানায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে করা মামলায় শাহজালালকে আসামি করা হয়েছে।
এ বিষয় মামলার বাদী মাহবুবুল আলমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমি আসামি কাউকে চিনি না। ওই এলাকার চৌকিদাররা যেসব নাম দিয়েছেন তাদের আসামি করা হয়েছে।’
এদিকে, গত দেড় মাসে মাত্র একজন এজাহারভুক্ত ও ৯ জন অজ্ঞাতনামা আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। নিরপরাধ মানুষকে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে ধরে হয়রানির অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
টাকা হলে ওসি শফিউদ্দিন সবই পারেন! ওসিকে টাকা দিলেই নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকেও রাজনৈতিক মামলার অজ্ঞাত আসামি করে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন। গত ২২ মার্চ কাশিয়ানী উপজেলার চরচাপ্তা গ্রামের কৃষক আনোয়ার হোসেন ডেলিমকে রাত সাড়ে ৮টার দিকে নিজ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যান এসআই হারুন অর রশীদ। ডেলিমের স্ত্রী রোকসানা বেগমের অভিযোগ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে ঘোনাপাড়া গ্রামের হাসিব নামে এক যুবকের সঙ্গে তার স্বামীর বিরোধ চলছিল। ওই যুবক ওসিকে টাকা দিয়ে তার স্বামীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে। তার স্বামী কোনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না।
আরজু রহমান নামে এক ভুক্তভোগী এক নারী জানান, জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে তার সৎমা আদালতে একটি চুরির মামলা দায়ের করেন। বিষয়টি তদন্ত করে ওসিকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন আদালত। ওসি শফিউদ্দিন উভয়পক্ষকে থানায় ডেকে সমঝোতা করে দেন। পরবর্তীতে প্রতিপক্ষের নিকট থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়ে গোপনে আদালতে মিথ্যা প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেন। ঘটনার দিন মামলার তিন নম্বর আসামি ঢাকায় চাকরিরত থাকলেও প্রতিবেদনে তাকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত দেখিয়েছেন।
উপজেলার সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কাশিয়ানী থানায় টাকা ছাড়া কোনো কিছুই হয় না। এ ছাড়া কাউকে আটকের পর তার আত্মীয়স্বজনরা কারণ জানতে থানায় গেলে ওসি খুব উত্তেজিত হয়ে যান। আসামির স্বজনদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন এবং অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন।
এসব ব্যাপারে কাশিয়ানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শফিউদ্দিন খানের সাথে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এসবের কোনও সত্যতা নেই।’ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এজন্য তাদের লোকজন প্রযুক্তির ব্যবহার করে মিথ্যা কল রেকর্ড বানিয়েছে। কল রেকর্ড তার নয় এবং ওই ইউপি সদস্যের সঙ্গে সামনে একবার দেখা হলেও মোবাইলে কোনও কথা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে গোপালগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘অভিযোগের তদন্ত করে তার (ওসি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি যদি প্রকৃত অপরাধী হন তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন